চারটি মিল, চরম দূষণ: তারাগঞ্জে কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হুমকিতে
বিশেষ প্রতিনিধি: রংপুরের তারাগঞ্জ উপেজলা সদরের পশু হাসপাতালর প্রাচীর ঘেঁষে একই স্থানে দুটি অটো রাইস মিল, একটি চিড়া ও একটি মুড়ির মিলসহ মোট ৪টি মিলের দূষিত বর্জ্য, ছাই, তুষ, দুর্গন্ধযুক্ত পানি ও মেশিনের বিকট শব্দে এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাব দূষিত হচ্ছে। বিকট শব্দের কারণে এলাকার শিক্ষার্থীদর পড়াশােনা ব্যাহতসহ এলাকাবাসীর রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। মালিক আওয়ামী লীগের জামাতা হবার কারণে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মিল এলাকার জমি কেনার জন্য একের পর এক মামলায় ফাসাচ্ছে এলাকার নিরীহ মানুষকে।
এলাকাবাসীরা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযাগ দিলেও অভিযাগকারীকে মামলা দিয়ে ও হামলা করে হয়রানী করা হচ্ছে । তাদের মামলা হামলার শিকার হয়ে অনেকে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। মিল সংলগ্ন আবাদি জমি তাদের কাছে বিক্রি না করায় উত্তর ঘনিরামপুর (পশু হাসাপাতাল সংলগ্ন ) ফেরদৌস কসাই নামের এক ব্যক্তিকে ১৩টি মামলা দিয়ে হয়রানী করা হয়েছে বলে অভিযাগ পাওয়া গেছে। আরও জানা যায়, অনুকুল রায় নামের এক ব্যক্তিকে ফাঁদে ফেলে তার জমি দখল করাসহ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে মিলে কাজ করা কিছু কর্মচারীদের মাধ্যমে মসিউর রহমান লিটন ও তার ভাই মনিরুজ্জামানকে পিটিয়ে জখম করে জােরপূর্বক ৫৬ শতাংশ জমি লিখে নিয়েছে মিল মালিক কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম রাসেল ওই অটোমিলের দূষিত বর্জ্য, ছাই, তুষ, মানুষের বাসা বাড়িতে প্রবশ করে পরিবেশ দূষিত করছে বলে অভিযোগ করেন। এছাড়াও দুর্গন্ধযুক্ত পানি ও মেশিনের বিকট শব্দ এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত করছে বলে তিনি সভার সদস্যদের অবহিত করেন।
তারাগঞ্জ উপজেলা সদর বাজার থেকে ৩শ’ মিটার ও উপজেলা পরিষদ চত্বর থক ২শ’ গজের মধ্য তারাগঞ্জ উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিসের প্রচীর ঘেঁষে উত্তর ঘনিরামপুর (দৌলতপুর) এলাকায় রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে বিএএফপি প্রাইভট লিঃ ইউনিট-১, বিএএফপি প্রাইভট লিঃ ইউনিট-২ অটো রাইস মিল। এছাড়াও একই স্থানে রয়েছে ব্রাদার্স এগ্রাে ফুট প্রাডাক্টস ও রাইস মনুফ্যাকচারিং প্লান্ট নামের আরও একটি হাসকিং রাইসমিল বা চালকল। এছাড়াও এখানে আছে চিড়া ও মুড়ির মিল। তবে তাদের প্রধান গেটে শুধু ব্রাদার্স এগ্রো ফুড প্রাডাক্টস লেখা আছ।
উপজেলা খাদ্য বিভাগের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ তিনটি রাইসমিলকে চালের বরাদ্দ দেয় রংপুর জেলা খাদ্য অফিস থেকে। নির্দেশনা অনুযায়ী তারা বরাদ্দপত্র পেয়ে চাল খাদ্য গুদামে গ্রহন করেন ।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির জামাই ইব্রাহীম জােয়াদ্দার পরিবেশ আইন কে অমান্য করে জনবসতি এলাকায় মানুষের বাসাবাড়ি, পশু হাসপাতালের দেয়াল ঘেঁষে ও তারাগঞ্জ ওয়াকফো এস্টেট সরকারি কলেজ, তারাগঞ্জ বালিকা ও/এ স্কুল এন্ড কলেজ, তারাগঞ্জ শিশু নিকেতন, এমএইস আইডিয়াল স্কুলসহ মোট ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ১শ’ গজের মধ্যে অবৈধভাবে এসব অটো রাইস মিল নির্মাণ করেছে। মিলগুলােতে নেই নিজস্ব পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য শােধনাগারের ব্যবস্থা ।
উপজেলার থানাপাড়া এলাকার কৃষক মনসুর, শাহাদাত, শহিদুল, মনিজুল ও উত্তর ঘনিরামপুর এলাকার কৃষক সিরাজুল, হারুণ, লুৎফর, লতিফ, মিটু, ফরদস, দুলাল, আতিয়ার সহ কয়কজনের অভিযোগ, মিলের দূষিত পানি নালা দিয়ে পাশের কৃষি জমিতে পড়ে। ফলে গত প্রায় ৮ বছর ধরে মিলের আশপাশের কমপক্ষে ২শ’ বিঘা জমিতে ফসল উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে , এলাকার গাছগুলোতে কোন ফল হয় না, এলাকার বসতবাড়ির টিনগুলা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে , মিলের বিষাক্ত ছাই বাতাস মিশে শ্বাসকষ্টসহ চোখের দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়াসহ নষ্ট হওয়ার মত ঘটনা ঘটছে। মিলর বর্জ্য, তুষ, গুড়া, ভটভটিত করে উন্মুক্তভাবে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক দিয় বহন করে নিয় গিয়ে তিন ফসলি আবাদি জমি ও মহাসড়কর পাশের জমিতে ফেলে ভরাট করা হচ্ছে । এসব বর্জ্য, তুষ, গুড়া ও ছাই বাতাস ছড়িয়ে পড়ায় পথচারী ও এলাকার শিশু ও বয়াবদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে শ্বাসকষ্ট, কাশি ও চােখের সমস্যা সহ নানাবিধ মারাত্মক রােগে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক অনির্বাণ মল্লিক জানান, মিলের বর্জ্য, তুষ, গুড়া ও ছাই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ায় পথচারী, এলাকার শিশু ও বয়াবদ্ধরা আ্যাজমা, সিওপিডি, নিউমানিয়া সহ আরও বেশ কিছু জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়াও অটো রাইসমিল গুলোর দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি মাটির নিচ দিয়ে পাইপের মাধ্যমে তারাগঞ্জের উপর দিয় বয়ে যাওয়া সেচ খালে ফেলছে। আর এ বিষাক্ত পানি যাচ্ছে কৃষকের ইরি-বোরা ক্ষেতে।
উপজলা কৃষি কর্মকর্তা ধীবা রানী রায় জানান, জলবদ্ধতার বিষয়টি আপাতত আমার জানা নেই। তিন ফসলি জমিতে কলকারখানা স্থাপন করতে হলে কৃষি বিভাগের প্রত্যয়ন নিতে হয়। কিন্তু বিএএফপি প্রাইভট লিঃ বা ব্রাদার্স এগ্রো ফুড প্রাডাক্টস লিঃ এর তা আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি এখান যােগদানের আগে এটি স্হাপন করা হয়ছে। এ বিষয় আভিযাগ পেয়েছি, তিন ফসলি কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো। এছাড়া দিনরাত ২৪ ঘন্টা মেশিনর বিকট শব্দ ও ধান সিদ্ধ করার ট্যাংকিতে হাতুড়ি পেটানার ফলে উপজেলা সদরের পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদর পাড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটছে।
তারাগঞ্জ ও/এ বালিকা স্কুল ও কলেজের প্রভাষক খলিলুর রহমান খলিল জানান, স্কুল চলাকালে এ অটাে রাইসমিল সহ অন্যান্য মিল গুলা চালু থাকায়, বিকট শব্দ শিক্ষার্থীদের অতিষ্ট হয় করে তুলেছে। অনক সময় বাতাসে মিলের বর্জ্য, তুষ, ছাই উড়ে এসে জানালা দিয় শ্রেণী কক্ষ প্রবশ করে শিক্ষার্থীদর চোখ মুখ পড়ছে। একই কথা বলছন ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্কুল শাখার ইংরজি শিক্ষক মাখন চদ্র রায়। তারাগঞ্জ স্কুল ল ও কলেজের অধ্যক্ষ মা: শফিকুল ইসলাম জানান, এ মিল গুলোর ছাই স্কুল কলেজের পাশের একটি জমিতে স্তুপ করে রাখায় স্কুল ও কলেজ চালু থাকলে ছাই বাতাস উড়ে শিক্ষার্থীদর চোখ মুখে পড়ে। এজন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রতিদিনই অভিযোগ পাই। এ বিষয় রাইস মিল কর্তপক্ষকে একাধিকবার অভিযাগ দেওয়া সত্ত্বেও প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতার জামাই হওয়ায় কারণে প্রতিকার মেলেনি।
উপজেলা সদর কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফজালুল হক সরকার জানান, ছাই ও তুষ গাড়ীত বহনের আগে পানি দিয়ে বহন করার কথা। এছাড়াও ছাই ও তুষ যেখানে ফেলে সেখান তা পানি ছিটিয় দেওয়া হয় বলে মিল কর্তৃপক্ষ আমাকে বলছে। জনস্বার্থে এ বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।
এ বিষয় ওই মিলগুলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইব্রাহিম ও ইকরামুল জােয়াদ্দারের সাথে একাধিকবার ম যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তারা দেখা করতে অসম্মতি জানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মিলের এক কর্মকর্তা মোবাইল ফোনে এ প্রতিনিধিকে জানান, সব নিয়মকানুন মেনেই ২০১৪ সালে অটো রাইসমিল চালু করা হয়েছে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত চলছে।
উপজলা নির্বাহী অফিসার মাে: রুবেল রানা জানান, অভিযোগ পেয়েছি বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা হবে।