জাসদের উত্থান যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কি সব শেষ, এত রক্তক্ষয়, এত ত্যাগ, এত লড়াই, এত রক্তঘামশ্রম সবই গরলভেল! সবই বৃথা? জাসদ রাজনীতি কি ব্যর্থ? সবই কি শেষ হয়ে গেছে?না, সব শেষ হয়নি। কোনো আত্মত্যাগই ব্যর্থ নয়। জাসদ নামে দল নিঃশেষ হতে পারে, জাসদ রাজনীতি ব্যর্থ নয়। এই প্রশ্নের তত্ত্বতালাশ করা দরকার।
আমরা জানি দ্বন্দ্ব তত্ত্বেও কয়েকটি নিয়মের মধ্যে একটি নিয়ম হল, নেতির নেতিকরণ (Negation of Negation)। এই নিয়মটি প্রকৃতির ক্ষেত্রেও যেমন, রাজনীতি ও সমাজকেও এই নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ধানবীজ মাটিতে বপন করলে সেটি মাটির সঙ্গে মিশে ‘পচে’ যায়। তার নেতি (Negation) ঘটে। তা আর আগের ধানবীজে পরিণত হতে পারে না। ঠিক যেমন জাসদ আর আগের মত অবস্থায় ফিরতে পারবে না। তাহলে কী হবে সেই ‘পচে’ যাওয়া ধানবীজের পরিণতি। সেই ধানবীজ ‘পচে’ গিয়ে সেখান থেকে একটি অঙ্কুরোদ্গম দেখা মিলবে। ওই অঙ্কুরোদ্গম থেকে চারা গাছ গজাবে। সঠিক পরিচর্যা পেলে ওই চারাগাছ পূর্ণতা পাবে। সেই পূর্ণতা পাওয়া চারাগাছে ‘পচে’ যাওয়া ধানবীজের মত অসংখ্য ধানবীজের ফলন দেখা যাবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। সেই নিয়ম দিয়ে জাসদ রাজনীতিকেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
এখানকার কমিউনিস্টরা যখন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইকে প্রধান রাজনৈতিক করণীয় নির্ধারণ করতে গেছেন, তখন নানা সীমাবদ্ধতাসহ জাসদই প্রথম দেশীয় শাসকশ্রেণিকে ব্যাপক জনগণের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটাই জাসদের প্রধান রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং মৌলিক অর্জন।
জাসদ রাজনীতির পরিশীলিত রূপ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী থেকে প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয়েছে। বর্তমান যুগ হল পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগ। পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগে একটি স্বাধীন দেশের বুর্জোয়া শ্রেণিই হল সেই দেশের শ্রমিক, গরীব কৃষক এবং অর্থনীতির সূচকে নিচের দিকে গড়াতে থাকা ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের প্রধান শত্রু। তাই দেশীয় শাসক শ্রেণিকে উচ্ছেদের লড়াই হল প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম। তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর খনিজ সম্পদ ও সুন্দর বন রক্ষার লড়াই হল রাজনৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই এবং পরিবেশ রক্ষার সংগ্রাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন, নারীর ওপর নিগ্রহের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন হল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ হল মেহনতী জনগণের নিকৃষ্ট শত্রু। ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী লড়াইও অন্যতম মূল লড়াই। প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রামের অধীনস্থ করেই এসব সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। আর প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম হল দেশীয় শাসকশ্রেণির উচ্ছেদের লড়াই।আর একমাত্র জাসদই সেটা শুরু করেছিলো।।
আজকের বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা প্রমাণ করছে জাসদের রাজনীতি শতভাগ সঠিক ছিলো। ১৯৮০ সালে জাসদ বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার কর্মসূচি হিসাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ১৮ দফা ঘোষণা করে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে দাবি উত্থাপন করে আসছে। ফেডারেল কাঠামো রাষ্ট্র, প্রদেশ ও প্রাদেশিক সরকার কাঠামো, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা,স্বশাসিত স্থানীয় সরকার গঠন, সাংবিধানিক আদালত, স্বাধীন জুডিশিয়াল কাউন্সিল, বিচার বিভাগের পৃথককরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ এসকল প্রস্তাব সমুহ বাস্তবায়নের দাবি করে আসছে। আজকে সরকারের গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন কর্তৃক সুপারিশ করা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব সমুহের অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিরাজুল আলম খানের রাষ্ট্র সংস্কারের দর্শন ১৪ দফা কর্মসূচি ও জাসদের ১৮দফা কর্মসূচিকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। দেশের জনগণের মধ্যেও এসকল সংস্কার কর্মসূচি ব্যাপক গ্রহণযোগতা ও আস্থার সৃষ্টি করেছে। এটাতে প্রমাণ করছে জাসদের রাজনীতি শতভাগ সঠিক ছিলো।।
জাসদের কতিপয় নেতার রাজনৈতিক স্খলন ঘটেছে তাদের কেউ কেউ বাম বিচ্যুতি ও ডান সুবিধা ভোগ করতে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলসমূহের লেজুড়বৃত্তি করে উচ্ছিষ্ট ভোগের সুযোগ পেতে ক্ষমতাশ্রয়ী হয়েছেন কিন্তু জাসদের রাজনীতির কোন বিচ্যুতি ঘটেনি। ত্রীধা বিভক্ত জাসদের নেতাকর্মীদের সিংহভাগ আজও জাসদের রাজনৈতিক কর্মসূচি কে জনগণের মুক্তি সনদ হিসাবে চিহ্নিত করে আঁকড়ে ধরে আছেন। নেতাদের কেউ কেউ রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে আপোষ করলেও জাসদের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অধিকাংশ কোন আপোষের পথে হাটেন নি।। সে কারণে আবারও রাজপথে জাসদের উত্থান ঘটাতে জাসদের তৃণমূল নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে ঐক্য গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ জাসদ গড়তে ডাক এসেছে।।
আমাদের লক্ষ্য জাসদের ঐক্য।।
-বীর মুক্তিযোদ্ধা আহামেদ ফজলুর রহমান মুরাদ
সাবেক ছাত্রনেতা।