মিঠাপুকুরে ৫ মাসেও নববধূ আফরিনের রহস্যময় মৃত্যুর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসেনি
বিশেষ প্রতিনিধিঃ রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ৬নং কাফ্রিখাল ইউনিয়নের যাদবপুর পশ্চিম পাড়ায় স্বামীর বাড়িতে বিগত ১০/১১/২৪ইং নববধূ আফরিনের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনার প্রায় ৫ মাস পেড়িয়ে গেলেও আদালতে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসেনি।
নিহত নববধূ আফরিন(১৭) মিঠাপুকুর উপজেলার চেংমারী এলাকার মোঃ আমিনুর রহমান ও মোছাঃ আছমা বেগমের ২য় কন্যা। প্রায় আড়াই বছর পূর্বে একই উপজেলার কাফ্রিখাল ইউনিয়নের মোঃ ইসমাঈল হোসেনের পুত্র মোঃ মুরাদ হোসেনের সহিত পরিবারের সম্মতিতে ইসলামী শরিয়া মোতাবেক আফরিনের বিবাহ সম্পন্ন হয়ে ঘর সংসার করা কালে বিগত ১০/১১/২৪ইং রবিবার স্বামীর নিজ ঘরের বিছানা থেকে আফরিনের লাশ উদ্ধার করে মিঠাপুকুর থানা পুলিশ। যাহার মিঠাপুকুর থানার অপমৃত্যু মামলা নং-৬৪, তারিখ-১১/১১/২৪ইং।
উক্ত রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় মিঠাপুকুর থানায় ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ করলেও সে সময় অজ্ঞাত কারনে তাদের অভিযোগ নেয়া হয়নি। বরং থানা থেকে বলা হয়েছিলো মৃত আফরিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এলে এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিন্তু এতে নিরুপায় হয়ে নিহত আফরিনের নানি বিগত ৪/১২/২৪ইং স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদকর্মীদের দারস্থ হলে পরের দিন ৫/১২/২৪ইং দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা সহ স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে এ বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়।
৫ই ডিসেম্বর ২০২৪ইং “প্রতিদিনের বাংলাদেশ” পত্রিকার রিপোর্টের হেডলাইনে বলা হয় “রহস্যজনক মৃত্যুতে আদালতে মামলা, তদন্তে সিআইডি”।
নিহত নববধূ আফরিনের পিতা মোঃ আমিনুর রহমান জানান, আফরিন জন্মের পর থেকেই আফরিনের নানা-নানির কাছেই থাকতো। সেখানেই স্থানীয় কুমরগঞ্জ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় মুরাদের সাথে পরিচয় হয় আফরিনের, এরপরে মুরাদ তাকে ফুসলিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে পালিয়ে বিয়ে করে, পরবর্তীতে দু পরিবারের সম্মতিতে তাদের বাড়িতেই সংসার করছিলো আফরিন। সংসার করাকালে আফরিনের স্বামী মুরাদ সহ তাদের পরিবার থেকে প্রায়শই যৌতুকের টাকার জন্য আফরিনকে বিভিন্ন সময়ে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো যা আফরিন মাঝে মধেই মোবাইলে তার মা বাবাকে জানাতো।
এর আগে নিহত আফরিনের নানি নোরেজা বেগম বিগত ০৩/১২/২৪ইং মিঠাপুকুর আমলী আদালতে আফরিনের স্বামী মুরাদ সহ ৩জনকে আসামি করে পেনাল কোডের ৩০৬/৩৪ ধারায় একটি সি. আর. মামলা আনায়ন করলে সংশ্লিষ্ট আদালত তা আমলে নিয়ে সিআইডি, রংপুর কে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন। যাহার সি.আর. মামলা নং-৮৭২/২৪।
মামলার আরজিতে বাদী নোরেজা বলেন- আফরিন ছোট্ট থেকেই তার কাছে থাকতো। ১নং আসামি মুরাদের সহিত ভিকটিম আফরিনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং বিগত ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় ১নং আসামীর সহিত দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়। বিয়ের পর হতে ২নং আসামি ভিকটিমের শ্বশুর ও ৩নং আসামি ভিকটিমের শ্বাশুড়ি, ভিকটিমের বাবা মায়ের নিকট ২,০০,০০০/-(দু লক্ষ) টাকা যৌতুক আদায় করে নেন।
ঘটনার ৯দিন আগে ১নং আসামি ভিকটিমের নিকট ৫০,০০০/- টাকা ও একটি এন্ড্রোয়েড মোবাইল ফোন পিতার বাড়ী থেকে এনে দিতে হবে বলে দাবি করে। এ নিয়ে ১নং আসামীর সহিত ভিকটিমের ভয়ংকর ঝগড়াঝাঁটি হয়, ভিকটিম কে মারধর করে উক্ত টাকা ও মোবাইল ফোন এনে দিতে চাপ প্রয়োগ করে ভিকটিমের স্বামী ১নং আসামি মুরাদ হোসেন। ভিকটিম আফরিন মনের কষ্টে পাশেই তার নানীর বাড়িতে গিয়ে নানীকে উক্ত ঘটনার বিবৃতি করলে তিনি আশ্বাস দেন যে, ঢাকা থেকে ভিকটিমের বাবা মায়ের নিকট থেকে উক্ত টাকা ও মোবাইল ফোন এনে দেবেন, এবং বুঝিয়ে আসামীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
পরবর্তীতে বাদী নোরেজা বেগম বিগত ১/১১/২৪ইং ঢাকায় পৌঁছে ভিকটিমের বাবা মায়ের বাসায় অবস্থানকালে ১০/১১/২৪ইং দুপুর আনুমানিক ১ঃ৪৬ মিনিটে ভিকটিম আফরিন ১নং আসামি মুরাদের নাম্বার থেকে বাদী নোরেজা বেগমের মোবাইলে কল করে ভিকটিমের উপর টাকা ও মোবাইল ফোনের জন্য শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের কথা বর্ননা করে। এক পর্যায়ে ভিকটিমের পাশে থাকা ১নং আসামি ভিকটিমের নিকট হইতে জোরপূর্বক মোবাইল ফোন টি কেড়ে নিয়ে কল কেটে দেয়। পরবর্তীতে ঐদিনই সন্ধ্যা অনুমান ৬ঃ৫৭মিনিটে বাদী নোরেজার ছেলে তাকে মোবাইলে কল করে জানান যে, আফরিন নাকি গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যুবরন করেছে। সেসময় বাদী নোরেজা জানতে পারেন ভিকটিমের পিতাকেও ভিকটিমের স্বামীর মোবাইল ফোন থেকে ১নং আসামি ভিকটিমের স্বামীর, ছোট ভাই কল দিয়ে আফরিনের মৃত্যু খবর জানায়।
আফরিনের মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্র বাদী নোরেজা বেগম ভিকটিম আফরিনের পিতা মাতাকে নিয়ে রংপুরের মিঠাপুকুরের উদ্দেশ্য রওনা দেন এবং পরদিন ভোরবেলায় মিঠাপুকুর থানার সামনে বাস থেকে নেমে থানায় প্রবেশ করে দেখতে পান ভিকটিম আফরিনের লাশ একটি গাড়ীতে শোয়ানো অবস্থায় রাখা হয়েছে। ভিকটিমের শরীরে ঢাকা দেয়া কাপড় সরিয়ে বাদী সহ ভিকটিমের পিতা মাতা দেখতে পান ভিকটিমের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন, বিশেষ করে ভিকটিমের বাম স্তনের নিচে গোলাকার জখম, ডান কাঁধের নিচে জখম, গলার দু পাশে নখ বসানো আঘাতের চিহ্ন এবং পিঠের সমস্ত জায়গায় জখমের চিহ্ন ছিলো।
বাদী নোরেজাকে তখন পুলিশের লোকজন বলেন তাহার নাতনী ভিকটিম আফরিন ঘটনাস্থল মিঠাপুকুর থানাধীন ৬নং কাফ্রিখাল ইউনিয়নের যাদবপুরস্থ পশ্চিম পাড়া গ্রামে ১নং আসামির ঘরে তীরের সাথে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ভিকটিমের নিকট আগে থেকে অবস্থান করা স্বজনরা বাদীকে জানান যে, পুলিশ ১নং আসামীর বাড়িতে গিয়ে ভিকটিমের লাশ ঘরের তীরের সাথে ঝুলানো অবস্থায় পায় নাই। পুলিশ ভিকটিমের লাশ বিছানায় শোয়ানো অবস্থায় পেয়েছে এবং স্বজনরাও লাশ শোয়ানো অবস্থায় গুছানো বিছানায় দেখেছে।
মামলার তদন্তকারী সিআইডি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, তদন্তকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেলেই পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।